শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৭

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম, একটি বিয়ে ও রাজনীতিক প্রেক্ষিত





গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান সরকার বিয়ে করেছেন। এরকম বিয়ে তো দেশে রোজই হয়। পাঠক বলতে পারেন, একজন রাজনীতিকের বিয়ে নিয়ে লেখালেখির কী আছে? ইমরান সরকার রাজনীতিক হলে কী হবে, বয়সে তরুণ। বিয়ে তো তাকে করতেই হবে। এই পাঠকদের বলি, রোজই তো তৃতীয় মতে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লিখি। আজ না হয় একটা লঘু বিষয় নিয়েই লিখলাম। পাঠকরাও একটু হালকা বোধ করবেন। বিয়ে তো সবই সমান; কিন্তু কোনো কোনো বিয়ের পেছনে একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থাকে। ইমরান সরকারের বিয়েতে সেই প্রেক্ষিতটার কথাই মনে পড়ল। তাই লোভ সামলাতে পারলাম না।

 

আরও একটা কারণ আছে এই বিয়ে সম্পর্কে লেখার। বহু আওয়ামী লীগ নেতার কাছে ইমরান সরকার এবং তার বর্তমান রাজনীতি অপছন্দের। এই ইমরান সরকার একেবারে আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছেন। তাতে শিক্ষামন্ত্রীর ভবিষ্যৎ ভেবে অনেকে শংকিত। জামাইয়ের বদৌলতে তিনিও দলের হাইকমান্ডের কাছে অচ্ছুৎ না হয়ে পড়েন! এক বয়োকনিষ্ঠ আওয়ামী নেতা আমার কাছে এই শংকা প্রকাশ করতেই তাকে বলেছি- বৎস, তিষ্ট ক্ষণকাল! এই জামাইয়ের বদৌলতেই আমাদের প্রিয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাগ্য আরও খুলে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন অনেক পরিপক্ব এবং দূরদর্শী। কথায় আছে, ‘প্রাণে যদি বাঁচতে চান, সাপের মাথায় ব্যাঙ খেলান।’ এই গুণটি শেখ হাসিনা এখন আয়ত্ত করেছেন।

 

ইমরান সরকার এবং তার গণজাগরণ মঞ্চকে আমি খুব পছন্দ করি। গণজাগরণ মঞ্চ তার আগের অতিস্ফীত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বৈকি; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা যে ঐতিহাসিক ভূমিকাটি পালন করেছে, সেটি সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারলে এই রাজনৈতিক প্লাটফরমটির এখনও একটি ভবিষ্যৎ আছে। আমি ঢাকায় গেলে ইমরান সরকার আমার কাছে আসেন (এবার ডিসেম্বর মাসেও এসেছিলেন)। তার সঙ্গে আসেন আমার প্রিয় অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত। থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অন্যতম ড. জাফর ইকবালের সঙ্গেও শাহবাগের মঞ্চে দেখা হয়েছে। আমরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করি।

 

ইমরান সরকারকে বলেছি, দেশে বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা এখন স্তিমিত। জাগরণ মঞ্চের প্রধান কর্তব্য এই ধারাটিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালানো। তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী অংশকে হিংস্র মৌলবাদের মোহ থেকে দূরে সরিয়ে এনে এই ধারার সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি একটা সুস্থ সেক্যুলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। যে কাজটি পঞ্চাশের দশকে শক্তিশালী বামপন্থী সংগঠনগুলো করেছিল।

 

এ ব্যাপারে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেন সাংঘর্ষিক না হয়, বরং পরিপূরক হয়। এই মুহূর্তে দেশে শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতৃত্ব নেই। এ কথাটা ইমরান সরকারও স্বীকার করেন। দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির নিভু নিভু বাতি আওয়ামী লীগ। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করার অর্থ হবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শত্রু রাজনৈতিক অপশক্তির বাহুতে শক্তি জোগান। যে কাজটি আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ডা. বদরুদ্দোজারা করেছেন এবং রাজনৈতিক ফসিল হয়ে গেছেন।

 

মঞ্চ এখন ছোট প্ল্যাটফরম হলেও তাকে সাহসের সঙ্গে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। শেখ হাসিনার বিরোধিতা নয়, আবার আওয়ামী লীগকে ঢালাও সমর্থন দানও নয়। আওয়ামী লীগে যাতে সুযোগসন্ধানী ডানপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে, আওয়ামী লীগ আপস ও সুবিধাবাদী রাজনীতির পথে চলে না যায়, সেজন্য আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের ওপর বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতির চাপ অব্যাহত রাখতে হবে; অন্যদিকে হাসিনার নেতৃত্বের ভিত্তিটি যাতে দুর্বল না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ; কিন্তু মঞ্চ যদি এ কাজটি সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে, তাহলে এখন তার অবস্থান যতই দুর্বল হোক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর শক্তিশালী বিকল্পধারাটি তৈরিতে তার সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বারো আনা।

 

এখন বর্তমানের বাস্তবতায় এবং বিয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট অনেকেই ভাবছেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের শত্রু হিসেবে বিবেচিত ইমরান সরকারের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে দলের হাইকমান্ড ভালো চোখে দেখবে না। এই বিয়েতে শিক্ষামন্ত্রী হয়তো মনে মনে বিব্রত হয়েছেন, যদিও প্রকাশ্যে মেয়ের ইচ্ছার বিরোধিতা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ মহলের একশ্রেণীর নেতার এই ধারণাটি সঠিক নয় বলেই আমার বিশ্বাস, কেন সঠিক নয় সেই কথাটি বলার জন্যই এই বিয়ে সম্পর্কে আমার আজ কলম ধরা। কারণ, এই বিয়ে যত স্বাভাবিক ও সাধারণ বিয়ে হোক, এর একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে গেছে।

 

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত এবং প্রয়াত ঔপন্যাসিক মনোজ বসুর ‘শত্রুপক্ষের মেয়ে’ অথবা ব্রিটিশ উপন্যাস ‘আইভান হো’ যারা পড়েছেন, তাদের কাছে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের কথা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। আওয়ামী লীগের অনেকের কাছে এখন ইমরান সরকার হয়তো শত্রুপক্ষ। এই শত্রুপক্ষকে ঘরে স্থান দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ভালো কাজ করেননি বলেও অনেকে মিছামিছি চিন্তিত হতে পারেন। আমার এই ধরনের বিয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ এই বিয়েতে সম্মত হয়ে অত্যন্ত ভালো কাজ করেছেন। নিজের দলের উপকার করেছেন। মন্ত্রিত্বের টোপে যে শত্রু বশ হতে চায়নি, এখন প্রেমের ফাঁদে পড়ে সেই শত্রু (আমি ইমরান সরকারকে আওয়ামী লীগের শত্রু মনে করি না) সহজেই বশ হতে পারে। অতীতের অনেক ঘটনা তারই সাক্ষ্য দেয়।

 

আমি দেশ-বিদেশের বড় বড় ঘটনা নয়, দেশেরই দুটি ছোট ঘটনা উদাহরণ হিসেবে টানব। রাজনৈতিক নেতা মাহমুদ আলীর কথা আমরা এখনও নিশ্চয়ই ভুলিনি। এককালে ছিলেন জাঁদরেল বামপন্থী, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ইয়ুথ লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ’৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। পাকিস্তানে তার মৃত্যু হয়। এই মাহমুদ আলী প্রথম যৌবনে ছিলেন একজন দুর্দান্ত তরুণ রাজনৈতিক সংগঠক; কিন্তু চরিত্রে ও স্বভাবে ছিলেন ডানপন্থী। অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি তখন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ মুসলমানদের মধ্যে তাদের ক্যাডার সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। মাহমুদ আলীর দিকে সহজেই তাদের দৃষ্টি পড়ে।

 

হাজেরা বেগম তখন কলকাতায় মুষ্টিমেয় আলোকিত মুসলিম তরুণীদের একজন। তিনি বামঘেঁষা। তাকে মাহমুদ আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। মুগ্ধ অথবা বিদ্ধ হতে মাহমুদ আলীর বেশি দেরি হল না। প্রেম থেকে পরিণয়। মাহমুদ আলী জাঁদরেল বামনেতায় পরিণত হলেন। পাকিস্তান হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রগতিশীল যুব আন্দোলন গড়ে তোলায় তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। হয়েছিলেন গণতান্ত্রিক দলের নেতা এবং হক মন্ত্রিসভার সদস্য। যদিও ’৭১ সালে তার পদস্খলন হয়।

 

আরেকটি উদাহরণ আমার বন্ধু, পঞ্চাশের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন হাসান হাফিজুর রহমানের বিয়ে। হাসান ছিলেন পঞ্চাশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একজন অগ্রনায়ক। গড়ে তুলেছিলেন এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী শক্তিশালী সাহিত্য আন্দোলন। চিন্তা-চেতনায় ছিলেন চরম বামপন্থী। আওয়ামী লীগকে মনে করতেন পেটি বুর্জোয়া দল এবং এই দল থেকে দূরে অবস্থান করতেন। ষাটের দশকে তিনি প্রচণ্ডভাবে চীনপন্থী বাম বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন।

 

ঢাকায় তৎকালীন আর্ট কলেজের এক তরুণী শিল্পীর সঙ্গে ছিল তার প্রেম। হয়তো বিয়েও হতো। ঠিক এ সময় আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য যশোরের মশিউর রহমানের সুন্দরী শ্যালিকার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়। হাসান হাফিজুর রহমান আমাদের বিস্মিত করে এই বিয়েতে সম্মত হন। মশিউর রহমান তখন ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।

 

এই বিয়ের পর হাসান ধীরে ধীরে বদলাতে থাকেন। আওয়ামী লীগের প্রতি তার বিরূপতা কমে যায়। ১৯৭২ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দেয়া চাকরি গ্রহণ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। পরে তার অকাল মৃত্যু ঘটে। এই বিয়ে নিয়ে পাঠান আমলের একটি গল্প বলে আজকের আলোচনা শেষ করি। সুলতানা রাজিয়া ছিলেন পাঠান আমলে দিল্লির সম্রাজ্ঞী। সে যুগের ‘ইন্দিরা গান্ধী’ ছিলেন অবিবাহিত। দোর্দণ্ড প্রতাপে সাম্রাজ্য চালাতেন। তার এক প্রভাবশালী সেনাপতি বিদ্রোহী হয় এবং কৌশলে সম্রাজ্ঞীকে বন্দি করে ফেলে। মুক্তির উপায় না দেখে সুলতানা রাজিয়া কৌশল খাটান এবং বিদ্রোহী সেনাপতিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।

 

সেনাপতি সানন্দে রাজি। এই বিয়ের পর সেনাপতিই হয়ে ওঠেন সুলতানা রাজিয়ার সবচেয়ে বড় সমর্থক। দরবারে কূটকৌশলী আমির ওমরাহের অনেক চক্রান্ত থেকে তিনি রাজিয়াকে রক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর মতোই সুলতানা রাজিয়া চক্রান্তের বলি হয়ে নিহত হন। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে তার সঙ্গে আত্মবলিদান করেন তার স্বামী সেনাপতিও। দুই শত্রুপক্ষের পরম শত্রুতাকে বিয়ে কী করে পরম মিত্রতায় পরিণত করেছে, সে সম্পর্কে এরকম অসংখ্য কাহিনী আছে দেশ-বিদেশের ইতিহাসে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার টোরি সমর্থক থেকে লেবার পার্টির সমর্থক এবং শেষ পর্যন্ত লেবার গভর্নমেন্টের প্রধান হয়েছিলেন, তাও বিয়ের কারণে- অর্থাৎ স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারের প্রভাবে।

 

আওয়ামী লীগের মন্ত্রীকন্যাকে বিয়ে করে ইমরান সরকার কতটা বদলাবেন বা বদলাবেন না তা আমি জানি না। তবে বদলালে বিস্মিত হব না। তবু এই বিয়ের সার্থক দিকটাই আমি দেখছি এবং নববিবাহিত দম্পতির শুভ কামনা করছি। এই বিয়ের একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত আছে। তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভ হবে বলেই আমার ধারণা। এই বিয়েতে আওয়ামী লীগের কারও চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। বিয়েটি আওয়ামী লীগের শত্রু নয়, মিত্রের সংখ্যা বাড়াবে।
  সূত্র-যুগান্তর
 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের কার্যালয়, চট্টগ্রাম, বিভাগীয় বিশেষ জজ।নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অনিয়ম!

 অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের কার্যালয়, চট্টগ্রাম,   বিভাগীয় বিশেষ জজ, আদালত, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে সরকারি বিধি অ...